প্রশ্ন-যজ্ঞে পশু বলি দেওয়ার যে রীতি তা এই যুগে কতটুকু প্রযোজ্য?
উত্তরঃ “অশ্বমেধং
গবালম্ভং সন্ন্যাসং পলপৈতৃকম্
দেবরেন সুতোৎপত্তিং কলৌ পঞ্চ বিবর্জয়েৎ”।
কলি যুগে পাঁচটি ক্রিয়া নিষিদ্ধ। অশ্বমেধ যজ্ঞ, গো মেধ যজ্ঞ, সন্ন্যাস, পিতৃপুরুষের শ্রাদ্ধে মাংস নিবেদন, দেবরের দ্বারা সন্তান উৎপাদন। শ্ৰীমদ
ভাগবতমে আছে যজ্ঞের নামে পশু বলি দিলে ভগবান প্রসন্ন হন না। যারা ধর্মের মাধ্যমে
নিজেদের পরিশুদ্ধ করতে চান, তাদের সমস্ত জীবের
প্রতি কায়, মন ও বাক্যে হিংসা
বর্জন করতে বলা হয়েছে। সারা পৃথিবী জুড়ে ধর্মের নামে পশু হত্যা হচ্ছে। ধর্মের
নামে বা আহারের জন্য পশু হত্যা অত্যন্ত জঘন্য কর্ম। নির্দয় না হলে মানুষ ধর্মের নামেই হোক বা আহারের জন্যই হোক পশু হত্যা করতে পারে না।
যজ্ঞের উদ্দেশ্য হচ্ছে ভগবান বিষ্ণকে সন্তুষ্ট করা। প্রতিটি জীব ভগবানের
সন্তান। তাই যজ্ঞে যদি পশু বলি দেওয়া হয় তবে কিভাবে ভগবান সন্তুষ্ট হবেন। যারা
এই রূপ কার্য করে তাহলে বুঝতে হবে তারা যজ্ঞের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে নিতান্তই অজ্ঞ।
শ্রীমদ ভাগবতমে ১/১৩/৪৭ এ বলা হয়েছে হস্ত রহিত প্রাণীরা হস্ত যুক্ত প্রাণীদের
শিকার, পদরহিত প্রাণীরা
চতুষ্পদ প্রাণীদের শিকার, দুর্বল জীবেরা
বলবান জীবদের জীবন ধারণের ভরসা এবং এক জীব অন্য জীবের খাদ্য। অহস্তানি অর্থাৎ
পশুপক্ষি গাছপালা আদি যে সমস্ত প্রাণীদের হাত নেই তারা সহস্তনাম অর্থাৎ যাদের হাত আছে সেই মানুষদের
খাদ্য। উপরোক্ত বর্ণনা
অনুযায়ী হস্ত রহিত কেবল গাছপালাই নয় পশুও মানুষের খাদ্য। তবে তা শুধুমাত্র তমোগুণ সম্পন্ন
মানুষদের জন্যই নির্ধারিত।
ধর্মের সৃষ্টি কোথায়? পৃথিবীতে এত ধর্ম কেন? জানতে ক্লিক ক্রুন
কীভাবে পশু মাংস খাওয়া যাবে সে সম্বন্ধে বেদের কর্মকাণ্ডে বর্ণনা রয়েছে। তবে এই নির্দেশ মাংস আহারের প্রতি উৎসাহিত করার জন্য নয় বরং তাদের নিবৃত্তি মার্গে আনার জন্য। বেদে বলা হয়েছে অমাবস্যার রাত্রিতে গভীর অরণ্যে যেখানে কালী মায়ের মন্দির আছে সেখানে পশু বলি দিয়ে কালী মাকে তা নিবেদেন করে গ্রহণ করতে। কালী মা যদিও তা গ্রহণ করেন না, কেননা তিনি হচ্ছেন পরম বৈষ্ণবী। মা কালী যে সমস্ত ভূত প্রেতদের আশ্রয় দিয়েছেন তারাই তা গ্রহণ করে। যারা মাংস না খেয়ে থাকতে পারে না এই সমস্ত তমোগুণ জাত মানুষদের প্রতি মাসে একবার। অমাবস্যার রাত্রিতে কালী মায়ের সামনে বলি দিয়ে পশু মাংস আহার করার এই রূপ অনুমতি শাস্ত্রে আছে । যাতে করে তারা ধীরে ধীরে মাংস খাওয়ার প্রবণতা কমাতে পারে। কিন্তু আজকাল কেউই এই বিধি মানছে না। বরং বেদে মাংস আহার করার অনুমতি আছে বলে নিজেদের জিহ্বার পরিতৃপ্তি কেবল করে। বেদের এই বিধিটি কেবল যাতে মানুষ যথেচ্ছাচারে পশু হত্যা না করে এবং ধীরে ধীরে পশু বলি দেওয়া থেকে বিরত হয় তার জন্য।
কখনও কখনও সরকার নাইট ক্লাব ও মদ খাওয়ার জন্য বারের অনুমতি স্বরূপ লাইসেন্স প্রদান করে। তার মানে এই নয় যে সরকার এই সকল কার্যকে উৎসাহিত করছে। বরং এর মাধ্যমে সরকার তাদেরকে নিয়ন্ত্রিত করছে যাতে করে তারা যেখানে সেখানে মাতলামি করে সমাজকে দূষিত করতে না পারে। এতে করে তাদের কখনও কখনও শুভ বুদ্ধির উদয় হয় এবং ভাবে আমি এমন এক অভ্যাস গড়েছি যা সর্বলোক সম্মক্ষে করা যায় না। এভাবে ভেবে সে অনুতাপ করে এবং এই সকল বদঅভ্যাস ত্যাগ করে। ঠিক শাস্ত্রে পশু বলি দেওয়ার বিধান এই উদ্দেশ্যেই রাখা হয়েছে।আরেকটি বিষয় লক্ষ্যনীয় যে অতীতকালে যজ্ঞে কেবল জড়াগ্রস্ত পশুদেরই বলি দেওয়া হতো এবং যে সমস্ত ব্রাহ্মণরা এই রূপ যজ্ঞ করত তারা ছিলেন অত তেজস্বী। তারা মন্ত্র বলে ঐ জড়াগ্রস্ত পশুটির একটি নতুন দেহ দান করতে পারতেন। কিন্তু বর্তমান কালে এই রূপ ব্রাহ্মণ নেই। কোনো জীবকে হিংসা করা মানে হচ্ছে তার হৃদয়ে পরমাত্মা রূপে যে ভগবান আছেন তাকেই হিংসা করা। এই বিদ্বেষ পূর্ণ আচরণের ফলে আমরা কখনই সজ হতে পারি না। বেদের অনেক স্থলেই প্রতিমার সম্মুখে পশু বলি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কোনো জ্ঞানবান ব্যক্তি যদি নিজের ইন্দ্রিয় তৃপ্তির জন্য যজ্ঞে পশু বলি দেয় তবে তাকে এই কৃত কর্মের জন্য নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে। আমরা জড় ভরতের জীবনীতে দেখতে পাই যখন জড় ভরতকে মা কালীর সম্মুখে বলি দেওয়া হচ্ছিল তখন স্বয়ং মা এসে ঐ বলি দাতাকে বধ করেছিলেন। এই দৃষ্টান্ত থেকে মা আমাদের শিক্ষা দিচ্ছেন পশু বলি দেওয়া অত্যন্ত ঘৃণ্য। এতে করে শ্রীমূর্তি কখনও পরমার্থপ্রদ হন না।
“মা হিংস্যাৎ সর্বানি ভূতানি" মানে সমস্ত জীবের প্রতিহিংসা পরিত্যাগ
করবে। এই বেদ বাণীর প্রতি লক্ষ্য করে যে কোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তিই বুঝতে পারেন সমস্ত
জীব মানে জগতে যত সবল, দুর্বল, ছোট, বড় জীব রয়েছে।
এরা সকলেই ভগবান কর্তৃক সৃষ্ট। ভগবান হচ্ছেন সকলেরই পিতা। তাই সন্তান রূপ কোনো জীবকে যদি যজ্ঞ
করে বলি দেওয়া হয় তবে ভগবান কীভাবে প্রীত হতে পারেন? ভাগবতমের ১১/৫/২৫ নং শ্লোকে বলা
হয়েছে “যে সব দাম্ভিক
ব্যক্তি ইহলোকে দম্ভ প্রকাশ
করে যজ্ঞে পশু বধ করে পরলোকে তারা বৈশাস নামক নরকে নিক্ষিপ্ত হয়। যমদূতগণ তাদের অশেষ যন্ত্রণা দেয়।
ভাগবতমের ৫/২৬/৩১ নং শ্লোকে আছে “ যারা পশু বলি দিয়ে ভৈরব বা ভদ্রকালী প্রভৃতি দেবদেবীর পূজা করে, হিংসা কবলিত সেই জীব যমালয়ে রাক্ষস হয়ে
পরবর্তীতে সেই ঘাতককে সুতীক্ষ তরোবারি দিয়ে বধ করে"। গীতার ১৭/১০ নং শ্লোকে ভগবান
বলেছেন, “অমেধ্যং ভোজনং তামস প্রিয়ম" অর্থাৎ অমেধ্য বস্তু ভোজন করা তামসিক লোকদের প্রিয়।
উপরোক্ত শাস্ত্রীয় আলোচনার ভিত্তিতে
এটাই প্রমাণিত হয় যে, পশু বলি দেওয়ার
যে বিধান তার অন্তনিহিত তাৎপর্য হচ্ছে পশু বলিকে নিয়ন্ত্রিত করা। এবং এই রূপ করার
ফলে কী ফল ভোগ করতে হবে তারও
অনেক প্রমাণ এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। তাই নিজেদের ইন্দ্রিয়ের লালসায় ধর্মের
অপপ্রয়ােগের মাধ্যমে পশু বলি দেওয়ার রীতি অত্যন্ত বিপদজ্জনক। যেকোনো বিবেকবান
ব্যক্তিত্ব শাস্ত্রের গুড় অর্থ হৃদয়ঙ্গম করে এই রূপ কার্য থেকে বিরত থাকবেন।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন