প্রশ্ন- সমাজে যত মত ও যত পথ আছে, তার যে কোনো একটি মত বা পথ অবলম্বন করলে কি ভগবানকে প্রাপ্ত হওয়া যায়?
উত্তরঃ আমাদের সমাজে অনেক নারী পুরুষ রয়েছে যারা শুধুমাত্র ধর্ম বিষয়ে অজ্ঞতার ফলেই প্রকৃত ধর্ম সম্পর্কে বিভ্রান্ত। তাই যখন তারা কাউকে কোনো অলৌকিক কার্য করতে দেখে বা শুনে তখন তাকেই ভগবান বলে মনে করে তার শরণাপন্ন হয় এবং তার দেখানো মত ও পথে ধর্ম অনুশীলন করা শুরু করে। অনেক যোগী, বাবা, ব্রহ্মবিদ আছে, যারা নিজেদের কিছু অনুগামী দিয়ে এক চিত্তাকর্ষক বাণী তৈরি করে ও তার প্রচার শুরু করে। অল্প কিছুদিনের মধ্যে সহজসরল ধর্মপ্রাণ মানুষ ঐ বাণীর অনুগামী হয়ে পড়ে এবং ঐ মতেই ধর্ম অনুশীলন করে। ঐ সকল মত শাস্ত্র অনুমোদিত কিনা তা না জানার ফলে তাদের ঐ মত বা পথের ধর্ম আচরণের ফলে কোনো আধ্যাত্মিক উন্নতি হয় না।
অনেক সময় দেখা যায় কোনো সিদ্ধ পুরুষ, যারা সত্যিকার অর্থেই ভগবান বা ভগবানের শক্তি কোনো দেবতার উপাসক ছিলেন। এই সকল মহাপুরুষরা অনেক তপস্যার ফলে তাদের সাধনায় সিদ্ধি প্রাপ্ত হয়ে অনেক সময় কিছু কিছু অলৌকিক কার্য করতেন। তাদের এই সকল পরহিতকর কার্য প্রশংসনীয়। কিন্তু কিছু অতি উৎসাহী লোক ঐ মহাপুরুষের প্রয়াণের পর তার গুণগান করা শুরু করে এবং কিছু দিনের মধ্যেই উনাকে ভগবানের অবতার কিংবা পূর্ণ ব্রহ্ম বলে তার উপাসনা শুরু করে। এ মহাপুরুষের ভজন স্থান এবং সমাধিতে তারা মন্দির তৈরী করে এবং সেখানে নিত্য পূজার আয়োজন করে।
Read More
দেব দেবী পূজার রহস্য Click
এভাবে একে অন্যের দেখাদেখি ধীরে ধীরে বহু লোক ঐ স্থানে সমবেত হতে থাকে। শাস্ত্র দৃষ্টিহীন সাধারণ ভক্তরা নিজের জাগতিক চাওয়া পাওয়াকে কেন্দ্র করে এই সকল বাবা, যোগীদের নিকট যাতায়াত করা শুরু করে। যদি কারও কঠিন রোগের মুক্তি, নিঃসন্তান ব্যক্তির সন্তান প্রাপ্তি, হঠাৎ অনেক ধন প্রাপ্তি এই রূপ খবর শুনে, তবে তা লোকমুখে আরও প্রচারিত হয়ে সমস্ত দেশজুড়ে এক নতুন পথের অনেক অনুসারী গড়ে উঠে। মানুষ যেহেতু ধর্মভীরু তাই এই নব্য পথের অবজ্ঞা করলে কোনো পাপ হবে বা নিজের কোন ক্ষতি হবে এই ভেবে এর কোনো শাস্ত্রীয় অনুমোদন আছে কিনা তা যাচাই করে না।
অনেক আধ্যাত্মবাদী আছে যারা নিজেদের দর্শন খুব শক্তিশালী লেখনী ও মনোমুগ্ধকর বক্তৃতার দ্বারা সমাজের একটি বিশেষ শ্রেণিকে প্রভাবিত করে। যার ধীরে তারও অনেক অনুগামী হয়ে যায়। এই ভাবে সমাজে দেখা যায় অনেক মত ও পথ। কিন্তু একটু বিবেচনা করলেই দেখা যায় ভগবানকে প্রাপ্ত হওয়ার উপাসনা করার বহু পন্থা থাকতে পারে না।
ভগবান একজন এবং তাকে প্রাপ্ত হওয়া যায় তার নির্দেশিত পথেই। ধম তু সাক্ষাৎ ভগবদ্ প্রণীতম। স্বয়ং ভগবানই ধর্মের প্রবর্তক। তিনি যে নির্দেশ দিয়েছেন তাই একমাত্র পথ আর বাকি সব হচ্ছে ছল ধর্ম। এই সব ছল ধর্মের প্রণেতা ও অনুগামী উভয়ই নরকগামী হবে। এই জন্যই ত্রিকালজ্ঞ ঋষি মহর্ষি ব্যাসদেব মহাভারতের বনপর্বে (৩/১৩/১১৭) বলেছে “মহাজনো যেন গতঃ স পন্থা" । মহাজনদের দ্বারা নির্দেশিত পন্থাই একমাত্র পথ। দ্বাদশ মহাজনেরা সকলেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রদত্ত পথে সাধনা করে সিদ্ধি লাভ করেছেন এবং আমাদের জন্য তা অনুসরণীয় করে গেছেন। গীতা, বেদ, পুরাণে ভগবান যে পথ অবলম্বন করলে তাকে পাওয়া যাবে তার বর্ণনা দিয়েছেন। তাই আমাদের একমাত্র অনুসরণীয়।
স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ কলিযুগে চৈতন্য মহাপ্রভুরুপে এসে ভক্তভাব অঙ্গীকার করে দেখিয়ে গেছেন কীভাবে ভগবানকে ডাকতে হয় এবং কীভাবে ভগবানকে প্রাপ্ত হতে হয়। কিন্তু “জীবের সেবা কর”, “সবার উপরে মানুষ সত্য তার উপরে নাই”, “যে যেভাবে ভজনা করবে সে সেভাবে ভগবানকে প্রাপ্ত হবে”, “শুধু আমাকে ডাক আমি মুক্ত করব” এই রূপ কথা রূপ অমৃত পান করে মানুষ হিতাহিতজ্ঞান শূন্য হয়ে পরমেশ্বর ভগবানের মুখ নিঃসৃত যে গীতা, বেদ, পুরাণ, উপনিষদ, শ্রীমদ্ভাগবতম আছে তাঁর বাণীকে উপক্ষো করে নিজেদের ইহ ও পরলোকের রাস্তাকে রুদ্ধ করে।
তাই শিক্ষিত সমাজকে সচেতন হতে হবে, শাস্ত্র চক্ষু দিয়ে দেখতে হবে, যাকে মানুষ ভগবানের মতো পূজা করছে তাদের নাম কী কোনো শাস্ত্র গ্রন্থে আছে? শ্রীমদ্ভগবদগীতায় ভগবান বলেছেন, “সর্ব ধর্মান পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ” (গীতা-১৮/৬৬)। অর্থাৎ সর্বপ্রকার ধর্ম পরিত্যাগ করে কেবল আমার শরণাগত হও। এটাই একমাত্র পথ । আর যারা বৈদিক শাস্ত্রকে উপেক্ষা করে মনের মতো ধর্ম পথ তৈরি করে তারা সমাজে কেবল উৎপাতেরই সৃষ্টি করে।
শ্রুতি, স্মৃতি-পুরানাদি পঞ্চরাত্র বিধিং বিনা।
ঐকান্তিকী হরির্ভক্তিরুৎপাতয়ৈব কল্পতে (ভক্তি রসামৃত সিন্ধু ১/২/১০১)
সাধু, শাস্ত্র আর গুরুবাক্য যদি এক না হয় তাহলে সেই পথ কখনই গ্রহণীয় নয়। দেখতে হবে আমরা যে ধর্ম আচরণ করছি তা কি শাস্ত্রে আছে, সেটা কি সাধু ব্যক্তিদের দ্বারা অনুমোদিত, গুরুদেবের উপদেশ কি শাস্ত্র অনুরূপ। সবাই নিজ নিজ মতকে প্রাধান্য দিবে কিন্তু আমাদের নিরপেক্ষভাবে বিবেচনা করে দেখতে হবে।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু যে ভবিষ্যতে আবির্ভূত হবেন তিনি যে সংকীর্তন প্রচার করবেন, সংকীর্তনই যে কলিযুগের যুগ ধর্ম, আরাধ্য ভগবান যে শ্রীকৃষ্ণ তা বল পূর্বেই মহাভারত, ভাগবতম, অথর্ব বেদ, উপনিষদ সমূহে উল্লেখিত হয়েছে। বৃহন্নারদীয় পুরাণে আছে “হরের্নাম হরের্নাম হরের্নামৈব কেবলম, কলৌ নাস্ত্যেব। নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব গতিরন্যথা”। অর্থাৎ “হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে, হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে” এই হরিনাম বিনা কলি যুগে পরিত্রাণ পাবার আর কোনো অন্য উপায় নেই। “ইতি ষোড়শকং নাম্নাং কলিকল্মষনাশনম নাতঃ পরতরোপারঃ সর্ববেদেষু দৃশ্যতে” অর্থাৎ এই ১৬ নাম ৩২ অক্ষর বিশিষ্ট হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্রই কলি কলষ নাশকারী, এর থেকে কোনো শ্রেষ্ঠ পথ সর্ব বেদে মধ্যে পরিলক্ষিত হয় না। সুতরাং এই সমস্ত শাস্ত্রীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভগবানকে প্রাপ্ত হওয়ার জন্য একমাত্র হরিনামকে আশ্রয় করতে বলা হয়েছে। কোনে মনগড়া মন্ত্র কখনও শাস্ত্র হতে পারে না। এই সম্বন্ধে অনন্ত সংহিতায় সাবধান করে বলা হয়েছে :
উৎসৃজ্যৈতন্মহামন্ত্রং যে তন্যৎ কল্পিতং পদম
মহানামতি গায়ন্তি তে শাস্ত্রগুরুলঘিনঃ।
তত্ত্ব বিরোধ সম্পৃত্তং তাদৃশং দৌর্জনং মতম।
সর্বথা পরিহার্যং স্যাদাত্মাহিতাৰ্থিনা সদ্য।।
এই মহা মন্ত্র বাদ দিয়ে যারা অন্যান্য মন কল্পিত পদকে মহানাম প্রভৃতি ব্যাখ্যা করে তারা শাস্ত্র ও গুরু লঙ্ঘনকারী। অতএব আত্ম হিতার্থী ব্যক্তি সর্বদা। সর্বতোভাবে তত্ত্ববিরোধী মতপথ গুলোকে দুর্জনের সঙ্গ জ্ঞানে পরিত্যাগ করবেন। একজন বির্যবান পুরুষের সাথে যেমন একজন নপুংশকের তুলনা চলে না তেমনি সহজ আকর্ষণীয় এই সব বাণীর সাথে প্রকৃত ধর্ম পথের কোনো তুলনা চলে না।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন