পাপ থেকে পরিত্রাণের উপায় কি?
উত্তর : প্রকৃতিতে সবকিছু সম্পাদিত হয় গুণ এবং কর্ম অনুসারে। কিন্তু অহংকারের দ্বারা বিমোহিত হয়ে মানুষ নিজেকেই কর্তা বলে অভিমান করে। মূর্খ মানুষ মনে করে ভগবান বা কোনো নিয়ন্ত্ৰা নেই এবং সে তার খেয়ালখুশি মতো যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। এভাবেই সে বিভিন্ন পাপকর্মে লিপ্ত হয়। কিন্তু শাস্ত্রে আছে সূর্য, চন্দ্র, বায়ু, অগ্নি, আকাশ, পৃথিবী, জল, দিবা, নিশি, উষা, সন্ধ্যা, ধর্ম কাল, পরমাত্মা এই চৌদ্দজন মনুষ্য কর্মের সাক্ষী। আমাদের পাপকর্মের ফল আমরা কোনো ক্রমেই এড়াতে পারি না। পাপকর্মের হিসাব রাখেন চিত্র গুপ্ত (Secrate Photographer)
। পাপীরা মৃত্যুর পর নরকে প্রবেশ করে। সেখানে বিভিন্ন পাপকর্মের জন্য সাজা প্রদান করা হয়।
আরোও পড়ুন
একাদশী কী? একাদশী কেন এবং কীভাবে পালন করতে হয়?
শ্রীমদ্ভাগবতমে ৫ম স্কন্ধে বিভিন্ন নরকের বর্ণনা রয়েছে। যে ব্যক্তি অপরের ধন, স্ত্রী অপহরণ করে তাকে তামিশ্র নরকে যেতে হয়। সেখানে তাকে ভয়ংকর প্রহার করা হয়, তাকে জল পান করতে দেওয়া হয় না। যে ব্যক্তি সংসার পোষণের জন্য অন্য প্রাণীকে হিংসা করে তাকে রৌরব নামক নরকে যেতে হয়। সেখানে সর্পের মতো রুরু নামক প্রাণী তাকে ভীষণ দংশন করে ও যন্ত্রনা দেয়। যে ব্যক্তি জিহ্বার তৃপ্তির জন্য নিরীহ পশু হত্যা করে, তাকে কুম্ভিপাক নামক নরকে গমন করতে হয়। সেখানে তাকে ফুটন্ত তেলে ফেলা হয়। যে ব্যক্তি অতিথি সকার করে না, বালক ও বৃদ্ধদের খেতে না দিয়ে নিজে ভক্ষণ করে তাকে কৃমি ভোজন নামক নরকে যেতে হয়। চুরির জন্য সন্দংশ নামক নরকে যেতে হয়। সেখানে সাঁড়াশি দ্বারা তার তৃক ছিন্ন ভিন্ন করা হয়। অবৈধ যৌনসঙ্গের জন্য তপ্তসূর্মি নামক নরকে গমন করতে হয়। সেখানে চাবুক দ্বারা তাকে প্রহার করা হয় এবং পরে তপ্ত লৌহময় পুরুষ বা নারী মূর্তিকে আলিঙ্গন করতে হয়। এই রকম বিভিন্ন পাপ কর্মের জন্য বিভিন্ন নরক ও শাস্তি রয়েছে।
মার্কন্ডেয় পুরাণে আছে গুরুদেবের সাথে কপট ব্যবহারের জন্য পরবর্তী জন্মে কুকুরের দেহ পেতে হয়। ধান, গম ইত্যাদি শস্যহরণের জন্য ইদুর হয়ে জন্মাতে হয়। অবৈধ যৌনতার জন্য শুকর, শিয়াল হয়ে জন্মাতে হয়। পিতা মাতার প্রতি ক্রোধের জন্য শালিক হতে হয়। ভূমি অন্যায়ভাবে দখল করলে নরক ভোগের পর উইপোকা, পিপড়া, ইদুর হতে হয়। মাছ, মাংস ভক্ষণের জন্য নেকড়ে, শিয়াল, বক হতে হয়। ভণ্ড সাধু হলে বিড়াল, বাঁদর হতে হয়। স্ত্রী কিংবা শিশুর খাদ্য হরণ করলে মাছি হতে হয়। নিষ্ঠুর প্রকৃতির পাপের ফলে নরক ভোগ শেষে পরবর্তী জন্মে খোড়া, কানা, কুষ্ঠ রোগ, বায়ু রোগ ইত্যাদিতে ভুগতে হয়।
মানুষের পাপ তিন প্রকার । এক হচ্ছে শারীরিক পাপ। যেমন চুরি, হত্যা ইত্যাদি। দ্বিতীয় হচ্ছে মানসিক পাপ। যেমন পর দ্রব্যে লোভ, অনিষ্ট করার চিন্তা ইত্যাদি। তৃতীয় হচ্ছে বাচিক পাপ । যেমন মিথ্যা বলা, পর দোষ কীর্তন করা, অসৎ প্রজল্প করা।তপস্যা, দয়া, সত্য, শৌচ এই চারটিকে ধর্মের চারটি পা বলে শাস্ত্রে উল্লেখিত হয়েছে। পাপকর্মের ফলে ধর্মের এই চারটি পা ভগ্ন হয় । পশু হত্যার ফলে দয়া গুণ নষ্ট হয়, তাস, পাশা, জুয়া খেলার ফলে সত্য গুণ নষ্ট হয়, নেশা জাতীয় দ্রব্য অর্থাৎ মদ, গাজা, হিরোইন গ্রহণের ফলে তপস্যা গুণ নষ্ট হয়। অবৈধ যৌনতার জন্য শচৌতা গুণ নষ্ট হয়। তখন নামে বা আকারে মানুষ হলেও আমরা পশুরই তুল্য।
মানুষ কেন পাপ কর্ম করে? তার উত্তরে ভগবদ গীতায় ভগবান বলেছেন, “কাম এষ ক্রোধ এষ রজোগুণ সমুদ্ভব, মহাশনো মহা পাপমা বিদ্বেনমিহ বৈরিনাম” (গীতা-৩/২৭)। অর্থাৎ রজোগুণ থেকে কামের উৎপত্তি হয়, কামের অতৃপ্তির ফলে ক্রোধ হয়। এই কামই সর্বগ্রাসী পাপ, একেই জগতের প্রধান শত্রু বলে জানবে। আমরা যখন এই দেহকে আমি ও আমিই ভোক্তা বলে অভিমান করি এবং দেহের সাথে স্বার্থ সংযুক্ত ইন্দ্রিয় তৃপ্তির জন্য যা কিছু করি তাই পাপ ।
স্কন্দ পুরানে ব্রহ্মাজি বলেছেন, “হে কেশব যে ব্যক্তি আপনার ভক্ত তিনি সমস্ত ধর্ম আচরণকারী আর যে ব্যক্তি আপনার ভক্ত নয় সে সর্ববিধ পাপ আচরণকারী”। যেহেতু দেহধারী জীব কর্ম ছাড়া থাকতে পারে না তাই পাপ অথবা পূর্ণ কর্ম করা স্বাভাবিক। তাহলে এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? তার উত্তরে বলা হয়েছে। নিষ্কাম কর্ম করতে। অর্থাৎ ভগবানের প্রীতি বিধানের জন্যই কেবল কর্ম করা। উচিত। এই ধরনের কর্মের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। শাস্ত্রের বহু স্থানে পাপের প্রায়শ্চিত্তের কথা আছে। তবে এই বিধান হস্তি স্থানের ন্যায়। কেননা প্রায়শ্চিত্ত করার ফলে কিন্তু পাপ করার প্রবৃত্তি কমে না। পুনরায় পাপ করার বহু সম্ভাবনা থাকে। তিন প্রকার প্রায়শ্চিত্ত রয়েছে। কর্ম প্রায়শ্চিত্ত, জ্ঞান প্রায়শ্চিত্ত, ভক্তি প্রায়শ্চিত্ত। চান্দ্ৰআয়ন আদি যজ্ঞ হচ্ছে কর্ম প্রায়শ্চিত্ত। কিন্তু। এর দ্বারা বীজ রূপ পাপ করার প্রবৃত্তি দূর হয় না। অনুতাপ রূপ জ্ঞান প্রায়শ্চিত্ত দ্বারা পাপ বাসনা দূর হয় কিন্তু অবিদ্যার জন্য ঈশ্বর বৈমুখ্য দূর হয় না। কেবল কৃষ্ণ স্মরণই ভক্তি প্রায়শ্চিত্ত ।
ভগবদ্ গীতায় ভগবান বলেছেন, সর্ব ধর্মান পরিত্যজ্য মামেকং শরনং ব্রজ। অহং ত্বং সর্ব পাপেভ্যো মোক্ষ্যয়িষ্যামি মা শুচ ।। (গীতা-১৮/৬৫)। অর্থাৎ “সর্ব প্রকার ধর্ম ত্যাগ করে কেবল আমার শরণাগত হও। আমি তোমাকে সমস্ত পাপ থেকে রক্ষা করব । তুমি শোক কর না" । পাপ থেকে পরিত্রাণের জন্য অন্যসব কষ্ট সাধ্য প্রচেষ্টা বাদ দিয়ে কেবল আমাদের শ্রীকৃষ্ণকে পরম পরিত্রাতা বলে গ্রহণ করতে হবে এবং তাঁর স্মরণ নিতে হবে। অনুক্ষণ ভগবানকে স্মরণ করার পন্থাটি হচ্ছে “হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে” এই মহা মন্ত্র জপ ও কীর্তন করা। এতে চিত্তের সময়ে কলুষতা দূর হয়। শ্রীমদ্ভাগবতমে আছে “গুরুনাঞ্চ লঘুনাঞ্চ গুরুনি চ লঘুনি চ প্রায়শ্চিত্তানি পাপানাং জ্ঞাতত্বাক্তানি মহর্ষিভি ?” (ভাগবতম ৩/২/১৬) অর্থাৎ মহর্ষিগণ গুরু ও লঘু পাপের জন্য বিভিন্ন প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু হরিনামে এই রূপ ব্যবস্থা নেই। কেননা এই নাম স্মরণ মাত্রই পাপীগণ সর্বপাপ থেকে মুক্ত হয়। বৃহস্ বিষ্ণুপুরাণে আছে “নাম্নো হি যাবতী শক্তি ও পাপ নিৰ্হরনে হরেঃ, তাবৎ কর্তৃং ন শক্লোতি পাতকং পাতকী নরঃ”। অর্থাৎ এক কৃষ্ণ নামে যত পাপ হরে, পাপীর সাধ্য নাই তত পাপ করে। অতএব হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ কীর্তনের ফলে বহুকালের পুঞ্জীভূত পাপ ভস্মিভূত হয়, অধিকন্তু কৃষ্ণপ্রেম রূপ অমূল্য ধন প্রাপ্ত হয়।
কিন্তু কেউ যদি ভাবে হরি নাম নেওয়ার ফলে যদি সব পাপ চলে যায় তাহলে আমি পাপকর্মও করব সাথে সাথে হরি নামও জপ করব, তাহলে তার নাম প্রভুর চরণে মহা অপরাধ হবে। এবং এই অপরাধ থেকে মুক্তি লাভের কোনো উপায় নেই। তাই উপদেশ হচ্ছে অপরাধ শূন্য হয়ে লহ কৃষ্ণ নাম। সুতরাং পাপ থেকে পরিত্রাণের উপায় কেবলমাত্র ভগবানে শ্রীকৃষ্ণের দিব্য নাম, রূপ, গুণ ও লীলা কীর্তন করা ।
আরোও পড়ুন
সনাতন ধর্ম কী এবং সনাতন ধর্মের যুক্তি
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন