প্রশ্ন- মৃত্যু কী? মৃত্যু কিভাবে হয়- মৃত্যুর পর গতি ?
উত্তর : দেহিনোহস্মিন যথা দেহে কৌমারং যৌবনং জরা।
তথা দেহান্তর প্রাপ্তির্ধীরস্তত্র ন মুহ্যতি ।। (গীতা-২/১৩)
দেহীর দেহ যেভাবে কৌমার, যৌবন ও জড়ার মাধমে তার রূপ পরিবর্তন করে চলে, মৃত্যুকালে তেমনই ঐ দেহী (আত্মা) এক দেহ থেকে অন্য দেহে দেহান্তরিত হয়। স্থিতপ্রজ্ঞ পণ্ডিতেরা কখনো এই পরিবর্তনে মূহ্যমান হন না। মৃত্যু বলতে দেহের পরিবর্তনকে বুঝায়। প্রকৃতপক্ষে প্রতি মূহুর্তে আমাদের দেহের পরিবর্তন হচ্ছে। একটি শিশু তার ছোট অবস্থা থেকে কৌমার, কৌমর থেকে যৌবনে, যৌবন থেকে বার্ধক্যে পৌঁছে। দেহের এই রূপ শেষ পরিণতিটিই হচ্ছে মৃত্যু। স্বরূপে যেহেতু আমরা আত্মা তাই পণ্ডিত ব্যক্তিরা জড় দেহটির জন্য অনর্থক শোক করেন না। আত্মার মৃত্যু হয় না। মৃত্যুর সময় মন বুদ্ধি অহংকার সমন্বিত সূক্ষ্ম দেহ আত্মার সাথে ভ্রমণ করে।
সূক্ষ্ম দেহ পূর্ব দেহের সমস্ত কামনা, কর্মফল বয়ে নিয়ে যায় এবং তদানুসারে অপর একটি দেহ ধারণ করে। এভাবে জীব তার কর্ম অনুসারে জড় মন এবং ইন্দ্রিয় সমন্বিত একটি উপযুক্ত শরীর প্রাপ্ত হয়। যখন বিশেষ কর্মফল সমাপ্ত হয়, সেই সমাপ্তিকে মৃত্যু বলে। এবং যখন নতুন কর্মফল ভোগ শুরু হয় সে শুরুকে জন্ম বলে।
মন যখন জড় কামনা বাসনা থেকে মুক্ত হয়ে চিন্ময়ত্ব প্রাপ্ত হয় তখন তার আর জন্ম হয় না। মৃত্যু ভগবানের একটি রূপ। কেউ হয়তো বলতে পারেন আমি ভগবানে বিশ্বাস করি না, ভগবানকে দেখতে পাই না তাই বিশ্বাস করি না। কিন্তু ভগবান সকলকেই দর্শন দেবেন। যিনি ভক্ত তিনি ভগবানকে তার শ্যামসুন্দর রূপে দেখতে পাবে আর যিনি নাস্তিক তার নিকট সর্বগ্রাসী মৃত্যু রূপে দেখা দেবেন। “এবে না ভজিলে যশোদা সুত চরমে পরিবে লাজে” । সুতরাং মৃত্যুর সময় ব্রিতকর পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য বুদ্ধিমান ব্যক্তি ভগবানকে অন্বেষন করে তার শরণাগত হওয়ার সচেতন সিদ্ধান্তটি নিতে বিলম্ব করেন না।
শ্রীমদ্ভগবদগীতায় ভগবান বলছেন,
অন্তকালে চ মামেব স্মরনুক্তা কলেবরম।
যঃ প্রয়াতি স মদ্ভাবং যাতি নাস্ত্যত্র সংশয়।। (গী-৮/৫)
মৃত্যর সময় ভগবানকে স্মরণ করার জন্য আমাদের জীবনের শুরু থেকেই তাঁর রূপ, গুণ, লীলা, নাম জপ কীর্তনের অভ্যাস করতে হবে। সারা জীবন এই অনুশীলনের দ্বারা অন্তিম সময়ে আমাদের ভগবানকে স্মরণ হবে। আর যদি জীবনভর আমরা দেহ, স্ত্রী, পুত্র, পরিবার, অর্থ এই ধ্যান জ্ঞান নিয়ে থাকি তবে মৃত্যুর সময় তাই আমাদের স্মরণে আসবে। পরলোকে নিজেদের যাত্রাকে সুগম করার এই কৌশল গ্রহণ করে আমরা মৃত্যুকে জয় করতে পারি।
প্রশ্ন- শ্রাদ্ধ কথার অর্থ কী? শ্রাদ্ধ নিয়ম / কিভাবে এবং কেন শ্রাদ্ধ করা হয়?
উত্তর : শ্ৰদ্ধা শব্দ হইতে শ্রাদ্ধ কথাটি এসেছে। শ্রদ্ধা সহকারে যে কর্ম অনুষ্ঠিত হয় তাকে শ্রাদ্ধ বলে। "শ্ৰৎ সত্য: দধাতি যয়া সা শ্রদ্ধা, শ্ৰদ্ধয়া ক্রিয়তে যৎ তৎ শ্রদ্ধম” । অর্থাৎ শ্রদ্ধাপূর্বক কৃত কর্মের দ্বারা যে নিত্য বস্তু লাভ হয় তাকেই শ্রদ্ধা বলে । শ্রদ্ধা সহকারে শ্রীভগবানে নিবেদিত অন্ন ব্যঞ্জন আদি সামগ্রী পিতৃদেব ও মাতৃদেবীর উদ্দেশ্যে প্রদানের নামই শ্রাদ্ধ। আবার কোনো মাঙ্গলিক কার্যের প্রারম্ভে পিতৃ পুরুষের যে শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান করা হয় তাকে বিদ্ধি শ্রাদ্ধ বলে । পরলোকগত ব্যক্তি যে তিথিতে মৃত্যুবরণ করেছিলেন সেই তিথিতে শ্রাদ্ধ করতে হয়। তবে তিথি জানা না থাকলে যে মাসে মৃত্যুবরণ করেছিলেন সে মাসের দ্বাদশী তিথিতে শ্রাদ্ধ করতে হয়।
Read more
কিভাবে হয়- মৃত্যুর পর গতি Click here
পাপ পরিত্রাণ : স্বর্গ - নরক Click here
শ্রাদ্ধ কাল যদি একাদশী তিথিতে পড়ে তবে একাদশীতে শ্রাদ্ধ না করে তা দ্বাদশী তিথিতে করতে হবে। কারন একাদশী তিথিতে মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে অন্ন নিবেদন নিষিদ্ধ। যেহেতু জীবিত অবস্থায়ও একাদশীর দিন অন্ন গ্রহণ নিষিদ্ধ। এই দিন সমস্ত পাপ অন্নে অবস্থান করে। সেহেতু পিতৃপুরুষের মঙ্গল করতে গিয়ে ঐ তিথিতে অন্ন প্রদান করে আমরা উনাদের আরও দুর্গতিতে ফেলতে পারি ।
আমাদের সমাজে কত দিনে শ্রাদ্ধ হবে তা নিয়ে অনেক মতবিরোধ আছে। মনু সংহিতায় আছে “শুদ্ধেদ বিপ্রো দশাহেন দ্বাদশাহেন ভূমিপো:, বৈশ্য পঞ্চদশাহেন শুদ্ৰো মাসেন শুধ্যতি”। অর্থাৎব্রাহ্মণ ১০ দিনে, ক্ষত্রিয় ১২ দিনে, বৈশ্য ১৫ দিনে, শুদ্র ৩০ দিনে শুদ্ধ হন। তারপর তারা শ্রাদ্ধ কার্য করবেন। তবে এই বর্ণ বিভাজন ছিল গুণ এবং কর্ম অনুসারে। জন্ম অনুসারে নয়। তাই প্রকৃত ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শুদ্র নির্ধারণ বেশ দুরূহ। তাই শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু বলেছেন, “জীবের। স্বরূপ হয় কৃষ্ণের নিত্য দাস”। এটাই তার প্রকৃত পরিচয়। সর্বসাধারণকে এক জায়গায় আনার জন্য শাস্ত্রে ও উক্তি হলো “দশাহং শাবমাশৌচ: সুপিন্ডে বিধিয়তে” । দশদিন অশৌচ পালন অন্তে ১১ দিনের দিন শ্রাদ্ধ কার্য করা বিধেয়। তবে তা হতে হবে ভগবানকে নিবেদিত প্রসাদের দ্বারা, কোনো ক্রমেই মাছ মাংস ইত্যাদি দ্বারা নয়।স্কন্দ পুরাণে আছে “ একাদশাত্ত প্রাপ্তায়াং মাপিত্রোতেহহানি, দ্বাদশ্যা তৎ প্রদাতব্যং নোপবাসদিনে ক্বচিৎ, গহিতান্নং ন চাশন্তি পিতর দিবৌকসঃ” মাতালি পতার শ্রাদ্ধ একাদশীতে করিবে না বরং দ্বাদশীতে করিবে, কারণ দেবগণ, পিতৃগণ উপবাস দিনে গহিতান্ন অর্থাৎ পাপ মিশ্রিত অন্ন গ্রহণ করেন না। পরলোকগত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে যদি শ্রাদ্ধ করে পিণ্ড দান করা হয় তবে পরলোকগত আত্মা শান্তি পান। ব্রহ্মান্ড পুরাণে আছে শ্রাদ্ধ দিনে ভক্তি সহকারে শ্রী হরির মহাপ্রসাদ এবং তুলসী মিশ্রিত পিণ্ড পিত, দেবগণকে অর্পন করলে পিতৃগণ কোটি কল্প পর্যন্ত সম্পূর্ণ তৃপ্তি লাভ করেন ।
ভগবান ও ঈশ্বরের পার্থক্য
মনুস্মৃতি অনুসারে, পিতার জন্য তিনটি পিন্ড করা উচিত। পার্বণে মাতামাহ ইত্যাদির জন্যও তিনটি পিন্ড তৈরি করা হয়। দেহগুলি ঘণ্টার আকৃতির হওয়া উচিত। পিন্ডদানের পর ব্রাহ্মণদের খাবার খাওয়া উচিত। শ্রাদ্ধের পর হোম বলি দিতে হবে। এই উপলক্ষ্যে ভাই-বোন এবং বর্ণের লোকদেরও খাবার দেওয়ার আইন রয়েছে। শ্রাদ্ধের সময় গরুর দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, খির ইত্যাদি খাওয়ানো ভালো। পিতৃ লোক এবং প্রেত লোক ভুভারলোকের অংশ এবং ভু-লোকের প্রভাব তাদের কাছে পৌঁছে। পিন্ড থেকে উচ্ছিষ্ট খাবার উৎসর্গে, তিন প্রজন্মের বেশি অর্থাৎ চতুর্থ, পঞ্চম এবং ষষ্ঠ প্রজন্ম একে অপরকে আদান-প্রদান এবং প্রভাবিত করতে পারে। এগুলোকে সপিন্ড বলে। এর উপরের তিন প্রজন্মই কেবল আত্মসমর্পণের জল পেতে পারে। একে ব্যঞ্জনবর্ণ বলে। দশ প্রজন্মের পর সগোত্র বলা হয়। তর্পণ বা পিন্ডদান দশ প্রজন্মের উপরে মানুষের উপর কোন প্রভাব ফেলতে পারে না। কেননা এমন সময়ে একজন মানুষ সাধারনত স্বর্গে চলে গেছে বলে মনে করা যায়।
সাধারণত, পুত্ররা শ্রাদ্ধ করার জন্য উপযুক্ত পূর্বপুরুষদের জন্য শ্রাদ্ধ করে। কিন্তু শাস্ত্র অনুসারে, প্রত্যেক ব্যক্তি যিনি মৃত ব্যক্তির সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়েছেন এবং তার প্রতি ভালবাসা ও শ্রদ্ধা আছে, তারা স্নেহের বশবর্তী হয়ে সেই ব্যক্তির জন্য শ্রাদ্ধ করতে পারেন। শিক্ষার উত্তরাধিকার থেকে উপকৃত একজন ছাত্রও তার প্রয়াত গুরুর জন্য শ্রাদ্ধ করতে পারেন। পুত্রের অনুপস্থিতিতে পৌত্র বা প্রপৌত্রও শ্রাদ্ধ করতে পারেন। নিঃসন্তান স্ত্রীকে স্বামী, পিতা পুত্রকে এবং বড় ভাই ছোট ভাইকে পিন্ড দিতে পারে না। কিন্তু এমন অল্প বয়সের শিশু, যে উপনয়ন অনুষ্ঠান করেনি, সে বাবাকে জল দিয়ে নবশ্রাধ করতে পারে। বাকি কাজ পুরোহিত তার পক্ষে করেন।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন